অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রতি চারজনে একজন মানুষ এখনো দারিদ্রের সঙ্গে বসবাস করছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ দরিদ্র, যারা পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত থাকে। প্রায় চার কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডাব্লিউএফপি) বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি বিষয়ক এক কৌশলপত্রে এ কথা বলা হয়েছে। গতকাল বুধবার রাজধানীর শেরেবাংলানগরের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সম্মেলন কক্ষে এক সেমিনারে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে।
সবার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষুধার্ত ও অপুষ্টিতে ভোগা মানুষ নিয়ে দেশ অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর হতে পারে না। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে চাইলে অবশ্যই খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি খাতে বিপুল বিনিয়োগ করতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। পাঁচ বছরের কম বয়সী বাংলাদেশি শিশুদের ৩৬ শতাংশই মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ১৬ শতাংশ মারাত্মক অপুষ্টির শিকার। প্রজননে সক্ষম নারীদের প্রতি চারজনের একজন অপুষ্টিতে ভোগে। তারা নিজের উচ্চতার তুলনায় অনেক কম ওজন নিয়ে বেঁচে আছে।
প্রতিবেদনটিতে যোগ করা হয়েছে—‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিশুদের স্কুলে ভর্তি হওয়ার হার বাড়লেও প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার উপযোগী দেশের দুই কোটি শিশুর মধ্যে এখনো ৩.৩ শতাংশ স্কুলের বাইরে রয়েছে। আর যারা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হচ্ছে, তাদের মধ্যে ২০ শতাংশ শিশু পঞ্চম শ্রেণির আগেই ঝরে পড়ছে।’
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির কৌশলপত্রে আরো বলা হয়, সরকার যদিও নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তুকি দিচ্ছে, তবু লিঙ্গবৈষম্য দূর করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়েই রয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারী-পুরুষের বৈষম্য প্রবল। ১৮ বছরের আগেই দেশের তিন ভাগের দুই ভাগ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। ফলে তারা অল্প বয়সেই গর্ভবতী হচ্ছে। সে কারণে কম ওজনের বাচ্চার জন্মহার বাংলাদেশে বেশি। বাংলাদেশে ২০ শতাংশের বেশি নবজাতক কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য উন্নয়নে বড় বাধা বন্যা, সাইক্লোন ও খরা। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দরিদ্ররা আরো বেশি সংকটে পড়ে। তখন তাদের চাহিদার তুলনায় কম খেতে হয়, শিশুদের স্কুল থেকে প্রত্যাহার করে এনে কাজে লাগাতে হয় এবং সম্পদ বিক্রি করে টিকে থাকতে হয়। পানিবাহিত ও ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগবালাই দরিদ্র পরিবারগুলোকে আরো দরিদ্র করে দেয়।
ডাব্লিউএফপি জানায়, বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে শিক্ষার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩ শতাংশে। তবে এখনো পুরো জনগোষ্ঠীর ৩৮.৫ শতাংশ অশিক্ষিত রয়ে গেছে। অশিক্ষিতদের জন্য শহরে চাকরির সুযোগ কমে গেছে। এমনকি কম মজুরির তৈরি পোশাক খাতেও এ সুযোগ কমছে। শ্রমবাজারের ৮৫ শতাংশ চাকরিই টেকসই নয়। গ্রামাঞ্চলে অনানুষ্ঠানিক কর্মের ওপরই বেশির ভাগ মানুষ নির্ভরশীল; যেখানে কর্মঘণ্টা অনেক বেশি, মজুরি খুবই কম।
২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুপারিশ করে বলা হয়েছে, সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে খাদ্যে নিরাপত্তা অর্জন করতে হবে। অপুষ্টির হার কমাতে গণসচেতনতাসহ সংশ্লিষ্ট সবক্ষেত্রের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। সমাজের প্রত্যেক নাগরিককে এ কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। নারীদের বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে। চাষাবাদ পদ্ধতি ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে বৈচিত্র্য আনতে হবে। জোরদার করতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি।
প্রতিবেদনের অন্যতম গবেষক আয়ারল্যান্ডের অলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অর্থনীতির অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী বলেন, অপুষ্টির কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশের জনগণের উৎপাদনশীলতা কমছে, যার আর্থিক ক্ষতি বছরে ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি। এটি স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয়ের তুলনায় অনেক বেশি।
সেমিনারে প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সরকার খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবেদনে যেসব বিষয় উঠে এসেছে, তা দূর করার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হবে। আমরা ২০২৪ সাল নাগাদ পুরোপুরি ক্ষুধা দূর করব এবং ২০২৩ সাল নাগাদ পুষ্টি নিশ্চিত করব।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বাল্যবিবাহ বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে আগামী বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হবে। ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়া দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য বাধা। এ জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামালের সভাপতিত্বে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শহিদুল ইসলাম, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের যুগ্ম প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম, জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচির প্রতিনিধি ক্রিসটা রাদের, চিফ অব স্টাফ জেমস হার্ভে সেমিনারে বক্তব্য দেন।
পাঠকের মতামত: